• ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তেলবাজির তেলেসমাতি 

desk
প্রকাশিত জুলাই ৬, ২০২৪, ১০:৪৯ পূর্বাহ্ণ
তেলবাজির তেলেসমাতি 

Oplus_0

রাবিদ মাহমুদ চঞ্চল:-
আমাদের দেশে তেলের দাম কমানো সম্ভব নয়। আর কোন দিন কমবে বলে মনেও হয় না। কেননা তেলবাজির তেলেসমাতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের প্যান্টের দুই পকেটে কম করে হলেও দুটো তেলের ডিব্বা থাকে। যখন যেথায়,তখন সেথায় তেল মর্দনের জন্য আমরা সদা প্রস্তুত থাকি। এই তেল দিয়ে না হয় রান্না, না হয় জ্বালানি। মোটের উপর সারাদিন ধরে তেল মর্দনের পর ডিব্বা যত টুকু খালী হয় দিন শেষে বাড়ি ফিরে তা পূর্ণ করে নেওয়া হয়। পরদিন কোথায় কখন লেগে বসে বলাতো যায় না। শুধু মাত্র তেল মর্দনের তেজস্ক্রিয়তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বাঘব বোয়ালেরা এদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে বিদেশে। দেশে গড়ে তুলেছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। অতি সম্প্রতি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে জ্বলজ্বল করছে।
ডাক্তার মহাশয়রা বলে থাকেন তেল স্বাস্থ্যের জন্য মোটাও ভালে নয়। সমাজের অভিজ্ঞ জনরা বলে থাকেন-তেল মর্দন ভীষণ উপকারী। তাদের মতে বেশি বেশি তেল মারা আনে সফলতা ও উন্নতি! বর্তমানে তেলবাজি ছাড়া সমাজ চলে না। চলছে না দেশে। ঘুরছে না ভাগ্যর চাকা। যোগ্যতার তেমন কোনো মূল্য নেই। কে কত বেশি তেল মর্দন করতে পারি সেটাই এখন আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যোগ্যতার মাপকাঠি। আমাদের দেশে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও শাসকেরা তেল মর্দনকারীদের বড়ো বেশি মূল্য দেন। সামনে যেতে হলে একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে তেলবাজি বা তেল মর্দন। ব্যবসা, বাণিজ্য, নেতৃত্ব, পোস্টিং, প্রমোশন,ডিমোশন এসবই তেলবাজির গন্ডিতে আটকে গেছে। তেল মারা বা তেল মর্দন যেন আধুনিকতার অপর নাম হয়ে দাড়িয়েছে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে ব্যাপকতর অর্থে তেলের যে মানে, যে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট আলোচনা করেছেন, গত প্রায় ১০০ বছর ধরে আমাদের সমাজে তেলের সেই একই ভূমিকা রয়ে গেছে। আশা করা যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা বহাল থাকবে। কারণ,তেল মর্দন করতে পারা মানুষগুলোকে সমাজে সবাই ভালোবাসে। আর তেল হলো অপরকে পটানোর জন্য উত্তম ঔষধ। তবে তেল মর্দনের বিদ্যায় পারদর্শী হয়েও যারা জীবনে সফল হতে পারেননি, এমন অভাগাও সমাজে আছে। বর্তমানে আমাদের সমাজে যারা গলাবাজি করে জোর গলায় বলেন, আমি তেল মর্দন পছন্দ করি না, তেল মর্দন করতে পারি না,তারা আসলে সত্য বলেন না। এটা তাদের কথার কথা।  আসল ব্যাপার হলো, তিনি তেল মর্দন খুবই পছন্দ করেন, গোপনে তিনি তেল ঠিকই নিজেও মাখেন এবং  অপরকে মর্দন করেন কিন্তু অন্যের তুলনায় তা যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। কিংবা কোনো কারণে তেলে কাজ হয় না। তেলে কাজ না হলে আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। তেলের ওপর ঝাঁঝ মেটাই। তেল-দাতাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি। তেল মর্দন করতে পারি না বা তেল মর্দন পছন্দ করি না-এ কথা বলা আসলে তেল মর্দনের সুযোগ না পাওয়া বা তেল মর্দনেও কাজ না হওয়ার ব্যর্থতা জনিত ক্ষোভ বা রোষের প্রতিফলন। কাজেই মুখে যে যা-ই বলি, আসলে আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি তেলবাজ। দক্ষতা আর কার্যকারিতার ঘাটতি থাকতে পারে। তাই বলে তেল-বিমুখ কেউই নই।
তেল মর্দন বা তোষামোদি নিয়ে খুবই বিখ্যাত একটা গল্প হলো বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনেসের। রাজা ডেনেসের তোষামোদ করতেন না বলে তাকে খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হতো, যখন অ্যারিস্টোপাস নামে আরেক জন দার্শনিক রাজাকে খুশি করে খুবই আরামে-আয়েশে ছিলেন। তো একদিন অ্যারিস্টোপাস বাড়িতে এসে দেখলেন ডায়োজেনেস শাক দিয়ে ভাত খাচ্ছেন। অ্যারিস্টোপাস ঠাট্টা করে বললেন, ‘একটু তোষামোদি শিখলে তোমাকে শাক দিয়ে ভাত খেতে হতো না। ’ডায়োজেনেস উত্তরে বললেন, ‘আর তুমি যদি কষ্ট করে শাক দিয়ে ভাত খাওয়াটা শিখতে তাহলে তোমাকে অমন তোষামোদি করতে হতো না।’
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তেলের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এক অনবদ্য ধ্রুপদি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তেল প্রসঙ্গে সেই প্রবন্ধটির অংশবিশেষ উল্লেখ করা যেতে পারে-‘তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ—বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ করো অতএব আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কী? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে! সংস্কৃত কবিরা ঠিকই বুঝিয়াছিলেন। যেহেতু তাহারা সকল মনুষ্যকেই সমানরূপ স্নেহ করিতে বা তেল মর্দন করিতে উপদেশ দিয়াছেন। তেল মারা প্রসঙ্গে একজন তেলবিশারদ লেখক বলেছেন, ‘তিলে তেল হয়, কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা, তেলা মাথায় তেল দেওয়া। তেল মর্দন নিয়ে তেলেসমাতি কম হয়নি এবঙ্গে যা এখনো চলমান।
বর্তমানে আমাদের সমাজে উচিত কথা বললে মুখ কালো আর তেল দিতে পারলে খুব ভালো।  এখনো যে হচ্ছে না, তা নয়। হচ্ছে এবং আগের চেয়ে বেশিই হচ্ছে। তবে তেল এখন শুধু আর রঙ্গ নয়, এটি আমাদের দেহ ও সমাজের একটি অঙ্গ। সময়টাই এখন তেলের। চারদিকে শুধু তেল, তেল আর তেল। একটু ভালোভাবে তাকালেই দেখা যায় সবার গা থেকে এখন ঘাম নয়, যেন ফোঁটায় ফোঁটায় তেল ঝরছে। আমরা সবাই এখন একেকটি তেলের বিশাল বিশাল ভান্ডার। মূল জায়গায় কীভাবে এ তেলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়, তা জানার জন্যই আমরা সবাই এখন হন্যে হয়ে ছুটে চলেছি। তেল মারতে মারতে একেক জনের গায়ের চামড়া তুলে ফেললেও আমরা ক্ষান্ত হই না। উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত খুঁজতে থাকি আর কাকে তেল মর্দন যায়। বর্তমানে তেলের ব্যবহার যে যত বেশি আয়ত্ব করতে পারি জীবনে সে ততটাই উন্নতি করি। আমরা বিশ্বাস করতে শিখি তেলহীন বিদ্যা ফুটো পয়সার মতোই অচল। অন্যকে কীভাবে তেল মারা যায় তার কায়দাকানুন জানতেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিকে শাণিত করতে নিজেকে তেল মারার কথা আমরা চিন্তাও করি না। একটা প্রবন্ধে পড়েছিলাম(প্রবন্ধে নাম সঠিক মনে নেই)
তেলখেকো বাজারি কুকুরের গায়ে যেমন লোম থাকে না, সর্বত্র এভাবে তেল মারামারির ফলে আমাদের সমাজ-সংসারও আজ লোমহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের বিচার-বুদ্ধিতে জট লেগেছে, মরিচা ধরেছে। তবে মরিচা সারাতেও কিন্তু তেল লাগে। এটা যে কোন তেল, তা আমরা জানি। কিন্তু এখানে আমরা তা মারি কি?
যুগে যুগে তেল নিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড কম হয়নি। তেল নিয়ে কী সাংঘাতিক ঘটনা হতে পারে, তা আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যে। শুধুমাত্র তেলের দখল নেওয়ার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকা ইরাকসহ পুরো মধ্যপ্রাচ্য তছনছ করে দিয়েছে। এমনকি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অন্তনিহীত কারনও তেল। আধুনিক বিশ্বে তেল ছাড়া সবকিছু অচল। তেল আছে তো সব আছে, তেল নেই তো কিছু নেই। তেল ছাড়া কোনো কাজ হয় না।  তেল ছাড়া বাতি জ্বলে না, গাড়ি চলে না, বিমান ওড়ে না,চুলা জ্বলে না, জীবনও চলে না। তেল বেঁচে থাকবার অনিবার্য উপাদান, জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তেলচর্চা, তেলের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে মানুষের সাফল্য। তেল আছে বলে জীবন আছে। তেল ফুরিয়ে গেলে জীবনপ্রদীপও নিভে যায়।
আর তাই সমাজে তেল মর্দনের লোকের অভাব নেই। কে, কাকে কতটুকু তেল মেরে নিজের অবস্থা পাকাপোক্ত করবে, স্বার্থসিদ্ধি করবে, নেক নজরে আসবে, তা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো-যাকে তেল মর্দন করা বা তোষামোদ করা হয়, সেও এতে খুব খুশি হয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে মৌসুমী তেল মর্দনকারীদের দৌরাত্ম সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেখন ক্ষমতাসীন হন তখন তাকে এমন ভাবে তেল মর্দন করা শুরু হয় যে,তখন ক্ষমতায় বসা জন প্রতিনিধি ভুলে যান তিনি জনতার সেবক। সম্প্রতি দেশে কিছু রাঘব বোয়ালদের অবৈধ পাহাড় পরিমাণ সম্পদের হদিস মিলেছে, গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখবেন এরাও কারো না কারো তেল মর্দন করে নিজের নামে বা বেনামি এই অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ ধরনের তেলপ্রেমীদের কারণেই একটা দেশ, একটা জাতি, একটা গোষ্ঠি,একটা সমাজ, একটা সম্প্রদায়, একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের পথে। এটা নিয়ে কারো কোন হুঁশ নেই। মনে হচ্ছে আমরা সবাই যেন তেলবাজির তেলেসমাতিতে বেহুঁশ।
লেখক: গণ মাধ্যম কর্মী ও কলাম লেখক